১৯৬৯ সালের ২রা জুলাই ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এ নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক কাজ ছিল একটি সর্বজনীন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা । এ তালিকার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩,১২, ১৪,৯৩৫ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ২,৫২,০৬,২৬৩ জন । এ ভোটার তালিকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমমনা দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেও আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এককভাবে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক পৃথকভাবে প্রার্থী মনোনীত করে । মোট ৭৮১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন । জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের ছিল ১৭০ জন প্রার্থী এবং তাদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), নিখিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় জমিয়াতুল উলেমা ও নেজামে ইসলাম, ইসলামী গণতন্ত্রী দল, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) প্রভৃতি ।
নির্বাচনের ফলাফল:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে । সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগ মোট ১৬৭টি আসন লাভ করে জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । আবার পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ মোট ২৯৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । সে সময় জাতীয় পরিষদের সদস্যদের এমএনএ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের এমপিএ বলা হতো । ভোটের ফলাফল মূল্যায়নে দেখা যায়, মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ৭৫.১০% এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৭০.৪৮% ভোট পায় । নির্বাচনের এমন ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক অঞ্চল এবং বাঙালি জাতিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় এ দলের নেতৃত্বে সরকার গঠন হওয়া ছিল আইনসম্মত। কিন্তু, পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি আরম্ভ করেন। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন । এ ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । বিভিন্ন স্থানে জনতা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে । সারাদেশে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে বহু লোক নিহত ও আহত হয়। ঐদিন ছাত্রলীগের নেতারা 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করেন। এ সংগঠনের উদ্যোগে ২রা মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয় । এদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক ছাত্র সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেখানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । সমাবেশে ছাত্রলীগ ৫ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করে যা স্বাধীনতার ইশতেহার নামে চিহ্নিত করা হয় । এতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয় । এছাড়া ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধবেলা হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয় ।
ছাত্রদের এ ইশতেহারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা আপামর জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে হরতাল পালন করে । ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীরা অনুষ্ঠান বর্জন করেন। ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবীরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন । এ তিন দিনের হরতালে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে । বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে বহু লোক আহত ও নিহত হয়। ইয়াহিয়া খান এ পরিস্থিতিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে অগত্যা ৬ই মার্চ বেতার ভাষণে ২৫শে মার্চ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন । তবে তার ঘোষণা বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সে ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারেননি। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সামরিক শাসনবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসভার আয়োজন করা হয় ।
নির্বাচনের গুরুত্ব:
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক । ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের পর এটিই ছিল সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ একমাত্র জাতীয় নির্বাচন । ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাঙালি জাতি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে যে স্বাতন্ত্র্য দাবি করে আসছিল, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার বিজয় অর্জিত হয় । এছাড়া পূর্বাঞ্চলের জনগণ স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি করে আসছিল তা পশ্চিমাঞ্চলের সরকার অবৈধ বলে ঘোষণা করে । এ নির্বাচনের ফলাফলে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণিত হয়। সর্বোপরি ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এলে তিনি তা না করে নিরীহ বাঙালির ওপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন । শুরু হয় বাংলার মানুষের মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয় ।
আরও দেখুন...